“যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে টানিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
পঙক্তি দুটি অন্য প্রসঙ্গে লেখা হলেও এই ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হওয়ায় প্রবন্ধটি কবিগুরুর অসাধারণ পঙক্তি দু’টি দিয়ে শুরু করলাম। কুসংস্কার অর্থাৎ অন্ধবিশ্বাস দ্বারা সৃষ্ট পশ্চাৎমুখী মানসিকতা সমাজ সভ্যতার অগ্রগতিতে ব্যাঘাত ঘটায়, সমাজ সভ্যতার বিকাশ প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
কুসংস্কার শব্দটির আভিধানিক অর্থ, “ভ্রান্ত অন্যায় বা কদর্য ধারণা, রীতি অথবা ধর্ম বিশ্বাস।” অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী কুসংস্কারের বর্ণনা হল “ প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না এমন শক্তি বা এমন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস, অজ্ঞতা রহস্যময় কিছুর অযৌক্তিক ভীতি।”
অনেক কুসংস্কার কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও এই একবিংশ শতাব্দীতেও অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস, নানান ধর্মীয় আচার আচরণ পালন, জ্যোতিষ নির্ভরতা, গ্রহের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে রত্ন ধারণ ইত্যাদি মানুষের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। যার ফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাক্তি প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণের ভ্রান্তি থেকে মুক্ত না হয়ে সত্যানুসন্ধানের জ্ঞান অর্জনে ভুল পথে পরিচালিত হয়।
জীববিজ্ঞান অনুযায়ী মনুষ্য সন্তানের জন্ম ও বয়সন্ধিক্ষণের মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। মন হল মানুষের সেই মাধ্যম, যার দ্বারা তার আচরণ (চিন্তন, অনুভূতি এবং ইচ্ছা বা ক্রিয়া) প্রকাশিত হয়। মন মানুষের অভিব্যাক্তি। অর্থাৎ শিশুমন হল শিশুর চিন্তন, অনুভূতি এবং ইচ্ছার প্রকাশ হওয়ার মাধ্যম। শৈশব থেকেই প্রত্যেকের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় তার মন।
প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর মনোভাব আনন্দ ও বেদনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ধীরে ধীরে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশের সাথে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকটি শিশু কতকগুলি স্বতন্ত্র্য আচরণ করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং তার ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ শুরু হয়। মনোবিদ সি এইচ জাড এর মতানুসারে “মানুষের আচরণ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবসময়েই পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হচ্ছে। যে কোনও রকম আচরণের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনই হল বিকাশ”। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিজীবনের শুধুমাত্র মানসিক বিকাশ নয়, ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ ও পরিপূর্ণ বিকাশে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ পথনির্দেশ। যেহেতু বিকাশ এক ধরণের অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া তাই ভালো বা মন্দ যে কোনও দিকেই সে চালিত হতে পারেন। জন্মমুহূর্ত থেকে কৈশোর, এই সময়ের মধ্যে মানবশিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। তার উপরেই পরবর্তী ভবিষ্যৎ জীবনের গতিবিধি এবং বিকাশধারার ধরণ নির্ভর করে।
মনোবিদ আলপোর্ট এর বক্তব্য অনুযায়ী “পরিবর্তনশীল সক্রিয় জৈবিক মানসিক সত্তার যে সমন্বয় ব্যাক্তির অভিযোজনমূলক আচরণে তার নিজস্বতা প্রকাশে সহায়তা করে তাই হল ব্যাক্তিসত্তা।” ব্যাক্তিসত্তার বিকাশের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ব্যাক্তির মধ্যে স্বল্পহারে কিছু মানসিক সংগঠনের সৃষ্টি হতে থাকে, যার দ্বারা তাদের আচরণ বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাক্তিসত্তার বিকাশ শুরুর পর যখন শিশুর সামাজিক ও নৈতিক বোধ জাগ্রত হয় তখন থেকে চরিত্রগঠন আরম্ভ হয়। অর্থাৎ নৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতির দ্বারা বিচার্য ব্যাক্তিসত্তাই হল ব্যক্তির চরিত্র। মনোবিদ হারলক তার বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে প্রমাণ করেছেন যে বাল্যকালের বিভিন্ন আচরণ ও অভিজ্ঞতা ব্যাক্তির পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে।
একজন মানুষের ব্যাক্তিত্বর রূপ বিশ্লেষিত হয় সে নিজেকে কীভাবে চারপাশের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্ত করছেন বা কিভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তার ওপর ভিত্তি করে। ব্যাক্তিত্ব বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ শৈশবকালে যদি অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের সচেতন কিংবা অচেতন কারণবশত কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে তোলে তবে শিশুটির বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিশেষত পরিবার, শিক্ষাকেন্দ্র, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কোচিং বা গৃহশিক্ষক প্রভৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং শিক্ষানীতি, পাঠ্যক্রম, মিডিয়া প্রভৃতির পরোক্ষ প্রভাব শিশুমনে প্রতিফলিত হয়। মনে রাখতে হবে কুসংস্কার বিস্তারে রাস্ট্রের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। জয়ফুল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতে শিশুর মস্তিস্কের বিকাশ তার পরিবার, যত্নকারী,এবং সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হয়।
সাধারণত পাঁচ বছর বয়স থেকে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে অনেকসময় অনেকে অনুকরণ বা অনুবর্তনের শিকার হয়। বিভিন্ন কুসংস্কারের প্রভাবে অস্থায়ী ঋণাত্মক মনোভাব পরবর্তীকালে স্থায়ী আকার ধারণ করে ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করে। শিশুমনে কুসংস্কারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তাঁর চারিত্রিক আচার আচরণ গঠনে অর্থাৎ শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। প্রশ্নহীন অর্থাৎ অন্ধভাবে সব কিছুকে মান্যতা দেওয়া হলে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণে অনীহা জন্মালে ছোটবেলা থেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মানসিকতা তৈরি হয়। হীনমন্যতা, প্রশ্নহীন আনুগত্য, বিচার বিশ্লেষণ না করেই অন্যের কথায় সায় দেওয়া, বা বশ্যতা স্বীকার করা দুর্বল চরিত্রের লক্ষণ। এই মন যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল হয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবে স্বীয় ক্ষমতার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। অন্ধবিশ্বাসের পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠার ফলে পরবর্তী প্রজন্ম দূরদর্শিতার অভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। কুসংস্কার থেকে উদ্ভূত গোঁড়ামি পদে পদে নানান সমস্যা সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুটির উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্ধকার নামিয়ে আনে। শিশুর প্রতি আধিপত্য বজায় রাখা, তাকে নিজের বিশ্বাস মানতে বাধ্য করা সন্তানের ক্ষতি করে। শিশুমনে মানসিক অবসাদের সৃষ্টি করে।
মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী যেহেতু মানসিক স্থৈর্য, সংকল্প, স্থিরচিত্ত, প্রক্ষোভমূলক আচরণে সাম্য ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি সুচরিত্রের লক্ষণ, বিপরীতে মানসিক চাপল্য, সংকল্পের অভাব, প্রক্ষোভমূলক আচরণে অসমতা ইত্যাদি দুর্বল চরিত্রের লক্ষণ তাই এইসকল মানসিক সংগঠন প্রতিটি ব্যাক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই মানসিক সংগঠনের ভিন্নতার জন্য আদর্শেরও ভিন্নতা হয়। ব্যাক্তিসত্তা বিকাশের প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার প্রভাব না থাকলে আত্মসচেতনাও অসম্পূর্ণ থাকতে পারে।
তাই আমাদের সকলের উচিৎ আমাদের দেশের স্বার্থে,মানবসভ্যতার স্বার্থে সু-অভ্যাস ও সু-শিক্ষায় পুষ্ট শিশুমন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করা। কারণ যে কুশিক্ষা উন্নতির পথে অন্তরায় সেই কুশিক্ষায় পুষ্ট মানুষের ভারে জর্জরিত দেশ কোনওদিকেই উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। তাই একটা জাতির বলিষ্ঠ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার সময় যুক্তিনির্ভর ও প্রমাণযোগ্য নির্ভেজাল তথ্য পরিবেশন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব যাতে প্রতিটি শিশু প্রশ্নহীন আনুগত্য থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি ঘটনার পশ্চাতে কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনস্ক মন নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে।
সংবিধানের ৫১ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “ভারতের প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হল বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, মানবতাবাদ বিকশিত করা ও অনুসন্ধিৎসু ও সংস্কারমুখী হওয়ার”। তাই আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হওয়া উচিত,সংবিধানে বর্ণিত এই ধারার প্রতি সম্মান জানিয়ে সুস্থ নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্রতী হওয়া।
শেষ করি, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর অসাধারণ দুটি লাইন দিয়ে,
“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
এই অঙ্গীকার হোক আমাদের সকলের।